ফরিদপুর মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী এলাকায় গত ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুজন মুসলিম নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে স্থানীয় হিন্দু যুবক-জনতা ও জনপ্রতিনিধিরা। ঘটনার পরদিন কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার কিছু পর ওই এলাকার কৃষ্ণনগর গ্রামের একটি মন্দিরের ভেতরে মূর্তির গায়ে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। এটা প্রথমে দেখতে পায়, ওই মন্দিরের পূজারী মহিলা তপতী রানী মণ্ডল এবং তার চিৎকারেই অন্যরা জানতে পারে। এরপর কৃষ্ণনগরসহ গোটা পঞ্চপল্লীর হাজারো লোকজন, যাদের প্রায় সবাই হিন্দু, সেখানে জমায়েত হয়ে যায়।
মন্দিরের পাশে একটি স্কুলে সরকারি কাজের অংশ হিসেবে নির্ধারিত ঠিকাদারের অধীনে কর্মরত মুসলিম শ্রমিকদের হাত-পা বেঁধে স্কুলের ভেতরে আটকে রেখে মারধর শুরু করা হয়, শুধুই সন্দেহবশত। ওইসময় মারধরের ঘটনায় নেতৃত্ব দেয় ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) অজিৎ কুমার সরকার, ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) লিংকন বিশ্বাস, প্রভাষ কুমার ও বিনয় সাহা-সহ স্থানীয় হিন্দু লোকজন। ঘটনার শুরুর দিকেই ফোনে ডেকে আনা হয় ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান তপনকে। মারমুখী হিন্দুদের মধ্যেই চেয়ারম্যান নিজে নির্মাণ-শ্রমিক দুই মুসলিম সহোদর আশরাফুল ইসলাম ও আরশাদুল ইসলামকে পেটানো শুরু করে।
চেয়ারম্যানের সঙ্গে মেম্বার অজিৎকুমারও প্রহার করতে থাকে। প্রহারকারীদের হাতে ছিল নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য আনা রড, বাঁশ ও লাঠি। এরপর পরিস্থিতি আরো উত্তেজনা-মুখর হয়ে ওঠে। স্কুল কক্ষের ভেতরে-বাইরে অবস্থানরত হিন্দু জনতা কক্ষের ভেতর ঢুকে মুসলিম শ্রমিকদের মারতে থাকে। হিন্দু জনতার আক্রোশ ও ক্ষুব্ধতার সামনে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে চেয়ারম্যান তখন বেরিয়ে যায় এবং পরে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ নিয়ে আসে। ততক্ষণে দুজন মুসলিম সহোদর শ্রমিক নিহত হয় এবং দুজন মারাত্মক আহত হয়।
দুই.
বেদনাদায়ক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরদিন দু-চারটি নিউজ পোর্টালে নিউজ প্রকাশ হয়। কিন্তু নিউজের শিরোনামে জোর দেওয়া হয়, মন্দিরে আগুনের প্রসঙ্গটি নিয়ে। আগুন লাগানোর সন্দেহে দুই সহোদর নির্মাণ শ্রমিককে হত্যা করার কথা বলা হয় এবং এ-ও বলা হয়, উত্তেজিত ক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে এই দুই সহোদর মুসলিমের হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে।
কোনো কোনো গণমাধ্যমের নিউজের ভাষায় এমন একটি আবহ তৈরির চেষ্টা লক্ষ করা যায় যে, মন্দিরে কেউ আগুন লাগালে উত্তেজিত হিন্দু জনতার হাতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে যেতেই পারে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কিংবা দূষণীয় কিছু নয়।
দ্বিতীয়ত, তারা যেভাবে ঘটনা তুলে ধরেছে তাতে মনে হয়েছে, সন্দেহবশত শ্রমিকদের পিটিয়ে যে হত্যা করা হয়েছে- সেটি ছিল বাঁধভাঙা জনতার গণপিটুনি। যেন এঘটনার কোনো আসামী নেই। এ হত্যার কোনো হত্যাকারী নেই। এর কোনো বিচার নেই!
অথচ বাস্তবতা এমন ছিল না। প্রথম কথা, মন্দিরে সেদিন কে আগুন দিয়েছিল, এটা এমন এক রহস্যময় ঘটনা করে রাখা হয়েছে যে, ঘটনার ১২ দিন পর এপ্রিলের শেষ দিন পর্যন্ত সেটা উদ্ধার করা হয়নি; বরং ঘটনার দুদিনের মাথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে, মন্দিরের এ আগুনের সঙ্গে মুসলিম নির্মাণ-শ্রমিকদের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, কোনো মন্দিরে কিংবা মূর্তির গায়ে কেউ আগুন দিলেও তাকে পেটানো কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার কে কাকে দিয়েছে! এজন্য কি দেশে কোনো আইন নেই। ভুল আবহ তৈরির মধ্য দিয়ে মুসলিমকে সন্দেহ করে প্রহার ও হত্যার এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের ঘটনাকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ কি আছে?